ড. কানিজ আকলিমা সুলতানা
বেদনার আন্তঃস্রোতে ভাসতে ভাসতে এয়ারপোর্টে আসে। প্লেনে উঠে কাঁদে। স্বজনদের কত অনুনয় করে এসেছে তার সন্তানদের যেন একটু দেখে রাখে, একটু যত্ন নেয়।
সৌদিতে যাওয়া নারীরা সন্তানের ভাল জীবনের আশায় বা মা বাবার পরিবারের ভালোর জন্য ভিনদেশে যেতে রাজি হয়। বহু স্বপ্নের জাল বুঁনে তারা কাপড় গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। শেষ সম্বলটুকু অকৃপণ হাতে মাইক্রোবাসের ভাড়ায় খরচ করে পরিবার তাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে আসে।
পথে স্বজনের সাথে কথা হয়। স্বজন বলে ভয় নেই। সবার চোখেমুখে নিশ্চিত জীবনের চ্ছটা। এই সমাজ সংসারে যে নারীটি এতদিন তেমন কেউ ছিলনা, আজ বিদেশ যাত্রাকালে সে সকলের উজ্জ্বল আশার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেয়েছে।বাচ্চারা জানতে চায় আসার সময় মা কি কি আনবে, স্বজন জানাতে চায় তাদের কি কি লাগবে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে বিদায় নেয়ার কালটা বিরহে কাতর হয় সবাই। যাত্রীসহ সকলেই চোখ মোছে, কেউ কেউ শব্দ করে কেঁদে জড়িয়ে রাখে সম্পর্কগুলোকে। ইমিগ্রেশন পার হতে হতে এপাশের মুখগুলোকে যতক্ষণ দেখা যায়, ফিরে ফিরে দেখে নারী। কেউ একজন কোলের শিশুটাকে উঁচু করে ধরে। হাত নাড়ে মা, হাত নাড়ে শিশু। এজেন্ট তাড়া দেয় লাইনে চলতে, সামনে বাড়তে।
লাইনে দাঁড়িয়ে প্লেনে উঠার ধকল সেরে বসতে বসতে চারদিকে তাকায় নারী। কেউ নেই নিজের। একসাথে আসা কিছু মানুষ ছাড়া এখানকার চেহারা, ভাষা, আচরণ, সবকিছুই আলাদা। সবার কথা সে বোঝে, কিন্তু তবুও এরা কেউ তার জগতের নয়। হু হু করে উঠে মন।
আরও একটু পরে প্লেন চলতে শুরু করে। রানওয়েতে দৌড়াতে থাকে। তারপর উড়াল দিয়ে শূন্যে উঠে যাওয়ার সাথে সাথে শূণ্যতা ভর করে তার মনে। বাইরে অসীম আকাশ। এই আকাশ তাদের গ্রামের আকাশের মত নয়। এই আকাশটার কেমন যেন শুরু নেই, শেষও নেই। তাদের গ্রামের আকাশের সাথে জুড়ে থাকে গাছপালা, এর শেষ সীমানা এসে নামে ক্ষেতখামারে। নদীটার ওপারে আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকে থোকা থোকা মেঘ।
কষ্ট শুরু হয়। তার বাড়ি ঘর উঠান, তার ফেলে আসা বিছানা, স্বজনেরা, সব এসে খামচে ধরে হৃৎপিণ্ডটাকে। আর কি ফেরা হবে? কতদিনে দেখা হবে সকলের সাথে? নিজের শিশুরা কেমন করে থাকবে তাকে ছাড়া, সে কেমন করে থাকবে তাদের স্পর্শ ছাড়া? আবার কবে পাবে সবাইকে? পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কথা বলতে পারবে?
সব ছেড়ে সে যাচ্ছে ভিনদেশে। পরিবেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার, কাজ থেকে আচরণ, সব অচেনা। কি করবে, কেমন করে পারবে, সেই আশংকায় পানিশূন্য হতে থাকে শরীর। বিমানের সেবাদাতাদের কাছে পানি চায়। পানি আসতে আসতে আবার চায়।
নতুন এয়ারপোর্টে নেমে মন ভাল হয়ে যায় তার। নিজের দেশের এয়ারপোর্ট থেকে অনেক সুন্দর। চোখ ধাঁধানো আলো। সেখান থেকে বের হয়ে নরম কোমল গদিওয়ালা ঠান্ডা গাড়িতে বসে বাইরে তাকায়। বাংলাদেশের মত একটুও নয়। ফাঁকা ফাঁকা চওড়া চমৎকার সব রাস্তা, ছুটে চলা বড় বড় ঝকঝকে গাড়ি, ধু ধু জায়গায় খেজুর গাছ, বিরাট বিরাট বিল্ডিং। সব পরিষ্কার, সুন্দর, খুব সুন্দর!
এইটুকুই তার প্রথম প্রাপ্তি।
তারপর সে গিয়ে ঢোকে বন্দিশালায়। ফাঁদে পড়া ইঁদুরের জীবন নিয়ে বিশাল বাড়ির কাজ করে যায়। অন্ধকার ঘরে থাকার ব্যবস্থা। জানালা নেই। খানিক ঘুমের অবসরের পর জেগে উঠে কাজ, আর কাজের সাথে অত্যাচার। বেতের বাড়ি, বেল্টের বাড়ি, লাথি, এবং যৌন অত্যাচার।
দ্বিতীয় প্রাপ্তি বেতনটুকু। বাড়িতে পাঠায়। ফোন করে জানায়। কথা বলতে বলতে স্বজনের আনন্দিত গলায় কথা বলা শোনে, আনন্দের কান্নাও শোনে। ওপাশের উচ্ছ্বল খুশিতে সাহস পায়না ফিরে যাওয়ার কথা বলতে। তাই নিজের কান্নাটার গলা চেপে ধরে ভোতা গলায় জানায় আবার ফোন করবে, আবার টাকা পাঠাবে। সবাই যেন ভাল থাকে।
অতঃপর আবার কাজে লাগে। সয়ে যায়, এবং আবার বেতন পায়, দেশে টাকা পাঠায়।
কেউ কেউ আর পারেনা। ফিরতে চায়। গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা, পালা করে যৌন নির্যাতন। কাজ ভুল করলে লাথি খায়, মারের চোটে চোখ উল্টে খাবি খায়। পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, চিৎকার করে, বাপ ডাকে, ভাই ডাকে, মা ডাকে। কিন্তু কাজ হয়না। কান্নায় আরও অত্যাচার বাড়ে।
আহারে, কেন এসেছিল, কেমন করে ফিরবে সে, ফিরে গেলে কে তাকে জায়গা দিবে? এখনও ভাঙ্গা চালাটা সারাই হয়ে উঠেনি, বন্ধক দেয়া জমিটা ফেরত নিতে পারেনি, ঋণের অনেকগুলো কিস্তি বাকি রয়ে গেছে! সন্তানদের লেখাপড়া, বাবার চিকিৎসা, ভাইয়ের বিদেশ যাবার খরচ…সবই তো তার উপর।
এই জন্যই নারী আর ফিরতে পারেনা। চক্রে ঘুরতে থাকে দাস জীবন। ছুটি পেলে দেশে আসে। কম্বল আর ইলেক্ট্রনিকস কিনে আনে। এয়ারপোর্ট থেকে কিনে লোশন, নিভিয়া ক্রীম, নিডো গুড়া দুধের বিশাল প্যাকেট, বড় সাইজের ট্যাং এর টিন, চকলেট আর মোবাইল। জীবনের সর্বস্বের বিনিময়ে রোজগার করা টাকায় উপহার নিয়ে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করে। সিকিউরিটি চেকের পর ডাক আসার আগেই ছুটে যায় সবার আগে প্লেনে উঠবে বলে। কলকল করে কথা বলতে থাকে। সব হীনতা ভুলে প্লেনে উঠে। দেশে অপেক্ষমান স্বজনের মুখ দেখে করুণ সব কথা মনে চেপে রেখে ছুটি শেষে আবার ফিরে কয়েদখানায়।
কেউ কেউ আর সহ্যই করতে পারেনা। কাঁদতে থাকে। সারা শরীরে মারের দাগ, পোড়া দাগ, ঘা। খুঁড়িয়ে হাঁটে। তারা মুক্তি চায়। দেশে থাকতে চায়। কেউ হয়তো হাঁটেইনা। তারা বাক্সবন্দী হয়ে শুয়ে শুয়ে আসে। তবে প্লেনের মূল জায়গায় সে বাক্স থাকেনা, থাকে লাগেজ চেম্বারে। তাদের স্বজনরা এয়ারপোর্টে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারেনা, সন্তানরা তাকে ছুঁতে পারেনা। কারণ সে তো আর মানুষ হিসেবে ফিরেনা, ফিরে দাসের শব হয়ে, ফিরে আসে লাগেজ হয়ে।
শুধু নারীই পুরুষতন্ত্রের শিকার নয়, পুরুষও পুরুষতন্ত্রের শিকার। পুরুষতন্ত্র একটা আধিপত্যবাদি সিস্টেম। সেই সিস্টেমকে চালু রাখতে জন্মকাল থেকেই পুরুষের কোমলতা ও মানবতার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং তাকে ভারবাহী মানুষরূপে একটা কঠিন জীবনে ঠেলে দেয়া হয়।
পুরুষতন্ত্র পুরুষকে শেখায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভার পুরুষের উপর। নির্দেশ করে পারিবারিক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতিটি আর্থিক প্রয়োজনের ভারও তার উপর। তাকে শিক্ষায় ও কর্মে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। বংশ রক্ষার দায় মিটাতে হবে। নারী স্বজনদের চেয়ে শিক্ষায় ও উপার্জনে উপরের কাতারে থাকতে হবে।
পুরুষতন্ত্র শেখায় সুপিয়রিরিটি কমপ্লেক্স, ইগো, বাহুবল, লোভ, অনধিকার চর্চা, নারীকে বঞ্চিত করার ফর্মুলা ও মুঠোয় ভরার ফন্দি।
পুরুষতন্ত্রে পুরুষের জন্য কান্না নিষেধ। পুরুষের কোমল সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ নিষেধ। দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক গৃহস্থালী কর্মগুলোর প্রতি তার আগ্রহ থাকা নিষেধ। এই সিস্টেমে পিতামাতা, স্ত্রী ও সন্তানের দেখভাল থেকে মালামাল বহনের দায় তার। মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা থেকে এ্যাম্বুলেন্স ডাকার দায়িত্ব তার।
বাল্যকাল থেকে পুরুষকে ঠেলে উপরে উঠিয়ে তার মই কেড়ে নেয়া হয়। শৌর্য বীর্যে অনন্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে সে বাঁধা পড়ে কঠিন নিগড়ে। সন্ধান পায়না নিঃশর্ত আনন্দের। সে কখনও হয়ে উঠে রূঢ়, কখনও হতাশ, কখনও কেবলই ছুটে বেড়ায় পথ থেকে আরেক পথে।
জমি দখলের কালে, যুদ্ধের কালে, আধিপত্য বিস্তারের কালে পুরুষ তার মাসল ব্যবহার করে জয়ী হতে চেয়েছে। বিরোধী পক্ষের নারীদের ধর্ষণ করার মাধ্যমে গোষ্ঠীগত বিজয় নিশ্চিত করেছে। আজ যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত, এক ইঞ্চি জমিও এখন দখল করা যায়না, তবে কেন পুরুষকে এই নিষ্ঠুর সিস্টেমে বেঁধে রাখা হয়েছে?
আমার চারপাশের পুরুষরা মানবিক। তারা আনন্দের সাথে সমাজে বাস করতে চায়। যূথবদ্ধ জীবনে নারীর হাতে হাত রেখে চলে। কিন্তু সমাজ তাদেরকে মুক্তি দেয়না। চাপিয়ে দেয় বোঝার পর বোঝা।
আজ পুরুষ দিবসে পুরুষের শপথ হোক সকল অচলায়তন ভেঙ্গে স্বাভাবিক মানব সমাজ গড়ার। ভার শেয়ার করে, নারীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলার। নারী পুরুষ মুক্ত হোক তন্ত্র মন্ত্র থেকে, যুক্ত হোক নিঃশর্ত আনন্দে।